একটি হৃদয়গ্রাহী কারগুজারী: চলমান সংকটের মধ্যে তাবলিগের মূলে ফিরে আসা
তাবলীগের চলমান ইস্যুতে আমার এবং মেহনতের সাথীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ চলমান থাকা সত্ত্বেও ছোট্ট একটি ভালো খবর দিলাম, তাবলীগ জামাতের বিচ্ছিন্ন অংশ থেকে মূল জামাতে ফিরে আসা এক আলেমের জবানবন্দিঃ

তাবলীগের চলমান ইস্যুতে আমার এবং মেহনতের সাথীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ চলমান থাকা সত্ত্বেও ছোট্ট একটি ভালো খবর দিলাম, তাবলীগ জামাতের বিচ্ছিন্ন অংশ থেকে মূল জামাতে ফিরে আসা এক আলেমের জবানবন্দিঃ
আমি তাবলীগ পরিবারের সন্তান, তাবলীগের মেহনতের উসিলায় আমিও আমার ভাইয়েরা মাদরাসায় পড়েছি, আলেম হয়েছি। আমরা আমাদের তাবলীগওয়ালা বাবাকে কাছে থেকে দেখেছি। তেমনি দেখছি আমাদের উস্তাদ ও সমসাময়িক আলেমদেরকে। আমাদের মন মস্তিষ্ক জুড়ে পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের প্রভাব ছিল ব্যাপক। আবার আব্বার জীবনাচার, সুন্নাহর পাবন্ধি, রাত জেগে কিয়ামুল লাইল, তাহজ্জুদ, তাকওয়া পরহেজগারী, খোদাভীতি, ঈমানী জজবা দেখে দেখে আমরা বড় হয়েছি।
তাবলীগের চলমান সংকট যখন শুরু হয়, আমাদের উস্তাদরা যখন সাদ সাহেবের ভুল ধরে ক্লাসে কথা বলেন, তাকে মওদুদীর সাথে তুলনা করলেন। তখন বড্ড খারাপ লাগল। তার এসব কথাবার্তা শুনে একজন তালেবে এলেম হিসাবে বেশ কষ্ট পেলাম। সতের সালে তখন ঢাকার বড় এক মাদরাসায় দাওরা হাদীস পড়ছি। আমাদের শায়েখ বুখারীর দরসে সাদ সাহেবের গুমরাহী নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকরির দিতেন। মনটি তার প্রতি বিষিয়ে উঠলো। ইজতেমার আগে তিনি বাংলাদেশে এলেন। আমরা খবর পেয়ে তাকে ঘেরাও করতে এয়ারপোর্ট গেলাম। হাজার হাজার ছাত্র। বেফাক নেতারা ছুটে এলেন। রক্ত টগবগ বয়ান দিয়ে দ্বীনের হেফাজতের জন্য আমাদের জান দিতে তাশকিল করলেন। সেদিন কী যে উত্তেজনা। ওল্লাহী সেটি ছিল আল্লাহর জন্য। মাদরাসার ছাত্ররা সাদ সাহেবকে নিয়ে জুতা মিছিল করলো৷ অনেক অপমান জনক শ্লোগান দিল।
মিছিল শেষে মাদরাসা আসতে আসতে গাড়িতে এক তাবলীগওয়ালা সাথীভাই আমাদের জামাতের ছাত্র। মারুফ। পড়ালেখা ছাড়া বাকী সময় তাবলীগ করে।
সে বলল শিহাব ভাই, সাদ সাহেব ভুল করেছেন। তিনি আমাদের আকাবির। টঙ্গী ইজতেমায় ২২ বছর ধরে বয়ান করছেন। তার ভুলের প্রতিবাদ করা ঈমানী দায়িত্ব। কিন্তু জুতা ব্যবহার ও অশ্লিল শব্দে মিছিল আমার কাছে মনে হয়েছে এটি ঠিক হয় নি। এই করে একদিন আমাদের কওমী অঙ্গনের ছেলেরা বেয়াদব হয়ে উঠতে পারে। কোন আলেম বা উস্তাদের কোন ভুল হলে জুতা মিছিল করবে, এটা ঠিক না।
এরপর ইতাআতিদের পাঁচদিনের জোড় ঠেকাতে আমাদের মাদরাসা থেকে গাড়ী ভরে আমার টঙ্গীর ময়দানে গেলাম। রাতেই হুজুররা বাসায় চলে এলেন। মাদরাসার একজন সাহেবজাদাও ময়দানে গেলেন না। তখনও বিষয়গুলো বুঝিনি। সারারাত আমাদের দিয়ে ইট ভাঙ্গিয়ে টয়লেটের ছাদে উঠানো হলো। সকালে যখন হাজার হাজার তাবলীগের সাথী ময়দানে চারদিকে এসে জড়ো হয়ে তালিম শুরু করতে লাগলো। তখন অপরিচিত কিছু আলেম প্রকৃতির লোক এসে আমাদের উত্তেজিত করে ইট পাটকেল মারতে বললো। তখনো ছাত্রদের মধ্য এনিয়ে দ্বিধা চলছিল। কিছু অতি আবেগী ছাত্ররা ইতোমধ্যে সাথীদের উপর তিনতলা টয়লেটের ছাদ থেকে ইট পাটকেল মারতে লাগলো। নিচ থেকে বাবা চাচার বয়েসী মুবাল্লীগরা চিৎকার করে বলতে ছিলেন, আমরা তোমাদের বাপ-চাচা বয়সী। আমাদের কেন মারছো? আর টাস টাস করে খোলা আকাশের নিচে তাদের মাথা ফেটে রক্তাক্ত হচ্ছিল সাদা পাঞ্জাবী, কারো সাদা দাড়ি। এই দৃশ্যটি দেখে আমার মনটি একেবারে ভেঙ্গে গেল। এখানো তো আমার আপন বাবা চাচা মামারাও থাকতে পারেন। আমরা কাকে মারছি? কেন মারছি? শরীয়তে এর কী বৈধতা আছে? এর পরিনাম ফলই বা কী?
আমি নিচে নেমে এলাম, ইতোমধ্যে মার খেতে খেতে তাবলীগের টগবগে নওজেয়ানরা লোহার গেট ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ শুরু করেছে। ছাত্রদের হাতের লাটি কেড়ে নিয়েছে। একজন মারতে চাইলে দশজন সাথী আটকাচ্ছে, প্রচন্ড রাগে ফুঁসছেন কেউ কেউ। একজন চিৎকার করে বলছিলেন, বিগত এক বছর ধরে অন্যায় জুলুম করা হচ্ছে। কোথাও ইজতেমা করতে দেয়া হচ্ছে না। মসজিদে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। মসজিদের আমলে বাঁধা দেয়া হচ্ছে। আর সহ্য করা হবে না। তার হুংকার শুনে আমি ও আমার দুই সাথী ভয়ে দৌড়াচ্ছি। যে দিকে যাই সেদিকেই তাবলীগের সাথী। পালানোর সব পথ বন্ধ।
এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতে হঠাৎ আমার চোখের সামনে আমার মেঝো চাচাকে দেখলাম। তিনি বয়স্ক মানুষ। আমাদের পরিবারে দ্বীন আনার তিনিই প্রথম বুনিয়াদ। বাবা এই চাচার মাধ্যমে প্রথম তাবলীগে লেগেছেন। জেলার জিম্মাদার সাথী। চাচা আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন। হাউমাউ করে শিশুদের মতো কাঁদতে লাগলেন। তার চিৎকার করা কান্নায় কিছুই বুঝা যাচ্ছিল না। চাচার কান্না দেখে আমি ও আমার সাথীরা একেবারে ভেঙ্গে পড়লো। মেঝো চাচার কান্নায় আমরাও কাঁদতে থাকলাম। চাচা বুকে পীঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলতে ছিলেন, তোদের আলেম বানিয়েছিলাম কী আমাদের পেটানোর জন্য। ভুল করলে তোরা বুঝাতি। একবারের জায়গায় শতবার বুঝাতি। তোরা এখানে এসে আমাদের ইট মারলি? এটি কী করলি বাবা। তর বাবাও তো এখানে এসেছে। না জানি কি হয়েছে। মাথাটাথা ফাটলো কি না। আমার কান্না আরো বেড়ে গেল।
চাচাকে নিয়ে আমরা আব্বাকে খোঁজতে লাগলাম। তখন কান ধরে হাজার হাজার ছাত্রকে সাথীরা ময়দান থেকে নিরাপদে বের করে দিচ্ছে। আমাদেরকে কেউ কেউ বলল, সে কানধরা কাফেলায় যেতে। চাচা বললেন এরা আমার ছেলে। দেখলাম আহতদের গাড়ি করে হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করছেন কোন কোন সাথী। অনেকের রাগই ইতোমধ্যে থেমে গেছে। সবাই ভাবছেন ছেলেগুলোতো আমাদেরই। তাদের ভুল বুঝিয়ে হেফাজতের নেতারা এখানে এনেছে।
আব্বাকে আর খোঁজে পেলাম না। মাদরাসায় এসে বাড়িতে ফোন দিলাম। আব্বা বাসায় আসেন নি। পরদিন আব্বা বাড়িতে যাওয়ার খবর পেলাম। লজ্জা শরমে আব্বার সাথে আর কথা বলতে পারলাম না মোবাইলে ফোনে। দুমাস শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা আর অসুস্থ ছিলাম। সাথীদের বেশ কয়েকটি লাটির বাড়ি আমার উপরও পরেছিল। আজ এসে এতোদিন পরে মনে হয়, আমি যে অপরাধ করেছি, এর চেয়ে বেশি শাস্তি আমার পাওনা ছিল।
যখন বাড়িতে গেলাম। ইতোমধ্যে আমার বড় ভাই মুফতী সাহেব অনেক বিষয় তাহকীক করে মোবাইলে এনেছিল। সাদ সাহেবের ভুল আসলে কিছু নয়। বেশ কিছু কাটপিস। সব ছিল তার ইমারতকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র। আসল দন্দ আমীর বিহীন শূরা বনাম ইমারত নিয়ে।
একদিন রাতে আমরা সব ভাই আব্বা সহ খেতে বসেছি। আব্বা ইলেমের মাকসাদ ফতোয়া ও তাহকীক নিয়ে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন, যা শুনে আমি বিস্মিত হলাম। বড় ভাই সাদ সাহেবের বিষয়ে বিস্তারিত বললেন। বললেন আমাদের ও আমাদের উস্তাদদের ভুল বুঝানো হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে।
আব্বা বললেন, তোমরা আমাকে কিছু বলনি। চাপ সৃষ্টি করোনি এটি শুকরিয়া। আমাদের কোন কোন সাথীকে তার ছেলে এসে বলছে, তাদের বাবা মায়ের তালাক হয়ে গেছে। এক সাথে আর সংসার করতে পারবে না। কারন তিনি সাদপন্থী। কত ভয়ংকর কথা। কত ভয়ংকর উগ্রবাদী প্রশিক্ষন। ভাবা যায়? কিন্তু কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠেনি। তোমরা আমার ছেলে আমাকে জানো খুব ভাল করে। তোমাদের কী মনে হয় আমার ঈমান চলে গেছে? আমার আকীদা নষ্ট হয়ে গেছে? বাবা কথা বলতে বলতে চোখেঁর পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, জেনে রেখো, আমার কাছে আমার সন্তান, পরিবার পরিজনের চেয়েও দ্বীন বড়। আমি সবাইকে ছাড়তে পারব কিন্তু আমার দ্বীন, দ্বীনী মেহনত, ৩০ বছরের চেনা আমীরকে কখনো ছাড়তে পারবো না। এর সাথে তো আমার আখেরাতের মাসআলা জড়িত। কবর হাশরের সম্পর্ক জড়িত। আব্বার কান্নাভেজা কথা শুনে আমরা চার ভাই আব্বার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম।
সেই থেকে আমি মূলধারার সাথেই আছি। আমীরের সাথেই আছি। দ্বীনের সাথে দাওয়াতের মেহনতের সাথেই আছি…
– মুফতী আহমদ হাসান হাফিযাহুল্লাহ