ইতাআতের পরীক্ষা যেমন হবে : সীরাতের রোডম্যাপ ও শিক্ষা
কখনো লড়াই, কখনো সবর। কখনো প্রতিবাদ কখনো প্রতিরোধ। কখনো অপবাদ কখনো অপমান। কখনো পরাজয় কখনো বিজয়। কখনো নিরবতা কখনো বাহাদুরী। কখনো শক্তির জানান দেয়া, আবার কখনো নিজেকে চুপ করে রাখা। কখনো কৌশলি হতে হয়। কখনো জানের বাজি লাগাতে হয়। কখনো মানের বাজি লাগাতে হয়। কখনো নারায়ে তাকবির দিতে হয়, কখনো আবার নিরব থাকতে হয়। কখনো নেতার নির্দেশের কাছে জজবার কুরবানী করতে হয়। কখনো মতের উল্টো রায় হলে বরদাশাত করতে হয়। কখনো প্রতিশোধ এর জজবাকে দ্বীনের জন্য দাফন করতে হয়। কখনো আবার জান মাল সময় সবকিছুকে নিঃসংকোচে আল্লাহর দ্বীনের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিতে হয়।
এটাই সীরাতের শিক্ষা। এটাই নববী মেহনতের পথ ও পদ্ধতি। আমার কোন রায় ও চাহিদা থাকবেনা আনুগত্যের পরীক্ষার উপর। আমি এই পরীক্ষায় পাস হলে সফল। কারণ ইতিআত হেদায়তের দরজা। আমীরের আনুগত্য দ্বীনের জান।
তাই কখনো কখনো আর্দশিক জায়গা থেকে দাড়িয়ে প্রতিপক্ষের সাথে সমজোতা করে চলতে হয়। কখনো কখনো কৌশলের জায়গা থেকে সবরের উপর উঠতে হয়। কখনো কখনো বিরোধী শক্তির সাথে মিশতে হয়। কখনো আবার জানের বাজি লাগাতে হয়। যেভাবে কুরবানী হতে বলা হয়, সেভাবে কুরবানীর উপর উঠতে হয়। বসে থাকতে বললে, মতের উল্টো বসে থাকতে হয়। দাড়াতে বললে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সামনে এগোনো লাগলে সামনে চলতে হবে। পিছু হটতে বললে পিছু হটতে হবে। জান দিতে বললে জান দিতে হবে। সময় দিতে বললে সময় দিতে হবে। শত্রুর মূখে ফেলে দিলে সেখানে নিঃসংকোচে লাব্বায়েক বলতে হয়।
এখানে হায়াতুস সাহাবাহ থেকে হযরত সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিআল্লাহু আনহুম আজমাইনদের ইতিআতের দুটি হৃদয়বিদাড়ক ঘটনা উল্লেখ করছি, তা পাঠ করলেই আমার উপরোক্ত কথা সহজেই চোখে পানি ফেলবে…
এক.
সন্ধিপত্রে যখন লেখা হলো ‘এই সন্ধি আল্লাহর রসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর তরফ থেকে তখন কোরাইশ প্রতিনিধি সুহাইল প্রতিবাদ জানিয়ে বলল : ‘আল্লাহর রসুল’ কথাটি লেখা যাবে না; এ ব্যাপারে আমাদের আপত্তি আছে।’ এ কথায় সাহাবিদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। সন্ধিপত্র লেখক হজরত আলী (রা.) কিছুতেই এটা মানতে রাজি হলেন না। কিন্তু হজরত (ﷺ) নানাদিক বিবেচনা করে সুহাইলের দাবি মেনে নিলেন এবং নিজের পবিত্র হাতে ‘আল্লাহর রসুল’ কথাটি কেটে দিয়ে বললেন : ‘তোমরা না মানো, তাতে কি? কিন্তু খোদার কসম, আমি তাঁর রসুল।’
সবসময় হুংকার আর বিরোধী শক্তির সাথে কেবল লড়াই না করে কৌশলে আগে -পিছে বড়দের রাহবারী কদম কদম মেনে চলতে হবে। আপনি যদি লড়াইয়ের ময়দানে কৌশলি না হন, তখন টিকে থাকতে পারবেন না, আর টিকতে না পারলে তখন লড়াই করবেন কীভাবে? নিজের অবস্থানকে জানান দিতেই আপনাকে কখনো কখনো কৌশলি হতে হবে। নিজের জায়গা থেকে সাময়িক আড়ালে ডানে বামে যেতে হবে। সামনে কিংবা পেছনে নেতার নির্দেশেই চলতে হবে। অপমান কিংবা অপদস্ত সব কিছুই মাশওয়ারার উপরে বরদাশত করাই দ্বীন ও দ্বীনী মেহনতের জান।
দুই.
সন্ধিপত্র যখন লিখিত হচ্ছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটনাচক্রে সুহাইলের পুত্র হযরত আবু জান্দাল (রা.) মক্কা থেকে পালিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি শৃংখলিত অবস্থায় মুসলমানদের সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন এবং সবাইকে নিজের দুর্গতির কথা শোনালেন। তাঁকে ইসলাম গ্রহণের অপরাধে কি কি ধরণের শাস্তি দেয়া হয়েছে, তা-ও সবিস্তারে খুলে বললেন।
অবশেষে তিনি রাসুল (ﷺ)-এর কাছে আবেদন জানালেন : ‘হুযুর আমাকে কাফিরদের কবল থেকে মুক্ত করে আপনার সঙ্গে নিয়ে চলুন ।’ একথা শুনে সুহাইল বলে উঠলো : ‘দেখুন, সন্ধির শর্ত নিয়ে যেতে পারেন না।’ এটা ছিলো বাস্তবিকই এক নাজুক সময়। কারণ, আবু জান্দাল ইসলাম গ্রহণ করে নির্যাতন ভোগ করছিলেন এবং বারবার ফরিয়াদ জানাচ্ছিলেন : ‘হে মুসলিম ভাইগণ! তোমরা কি আমাকে আবার কাফিরদের হাতে তুলে দিতে চাও?’
সমস্ত মুসলমান এই পরিস্তিতিতে অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠলেন।
হযরত (ﷺ) আবু জান্দালকে বললেন : ‘আবু জান্দাল! ধৈয্য ও সংযমের সাথে কাজ করো। খোদা তোমার এবং অন্যান্য মজলুমের জন্যে কোনো রাস্তা বের করে দিবেনই। সন্ধি-চুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেছে। কাজেই আমরা তাদের সাথে বিশ্বাসভঙ্গ করতে পারি না। মুসলমানরা অশ্রু ভেজা চোখে তাদের ভাই আবু জান্দালকে দ্বীনের খাতিরে মক্কার র্নিযাতিত কাফেরদের হাতে তুলে দিল। তাই আবু জান্দালকে সেই শৃংখলিত অবস্থায়ই ফিরে যেতে হলো।
একভার ভাবুন! আমীরের আনুগত্যের পরীক্ষা হিসাবে কতটা সবর আর র্ধযের পাহাড় অতিক্রম করতে হয়ছিল তখন মুসলমানদের। আমরাতো সামান্য অপমান আর পরাজয়ে হায় হায় করে উঠি। নগদে বিপ্লব কায়েম করে ফেলতে চাই? সীরাত ভিত্তিক দাওযাতি মেজাজ, বিচক্ষনতা না থাকায় কৌশল র্চচার প্রেক্টিস করতে পারি না।
হুদাইবিয়ার সন্ধির দ্বারা নবিজীর ﷺ এর সর্বোচ্চ রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সন্ধি র্সবকালের রাজনৈতিকদের জন্য রোল মডেল।
কৌশলি পথ চলার রোডম্যাপ।
ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমরনীতি, অর্থনীতি, দ্বীনী আন্দোলন, সংস্কৃতি, সভ্যতা- সকল অধ্যায়ের সফল আদর্শ আমাদের নবিজী (ﷺ)। নবুয়্যতী জিন্দেগীতে যে কয়েকটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে হুদাইবিয়ার সন্ধি অন্যতম। কখনো কখনো নিজের জজবাকে কুরবান করে, রায়কে বুকে চাপা দিয়ে নেতার শতভাগ আনুগত্যের উপর কৌশল হয়ে বড়দের রাহবারীর উপর পথচলা সীরাতের একটি শিক্ষা!
হযরতজী দা.বা. বলেন, দাঈর মউত হবে সবরের ময়দানে, দাঈর দ্বীলের ভিতর ইনতেকাম বা প্রতিশোধের জজবা থাকবে না। এটি নববী মেহনতের বুনিয়াদী উসুল। মেনে মেনে করা, কদম কদম চলা, যতটুকো বকা হয় ততটুকো করা। কাজে কমবেশি না করা। যখন যেখানে যে নির্দেশ,আসে, সেখানে বড়দের রাহবারী মেনে সেভাবেই চলা। হক আদায় করে সে কাজ করে আবার নিজের কমিকামার জন্য তওবা ইস্তেগফার করা।
ঐতিহাসিক হুদাইবিয়া সন্ধিতে যেসকল শর্তারোপ ও সন্ধি করা হয়েছিল, বাহ্যিকভাবে তা মুসলমানদের জন্য মানহানীকর মনে হলেও আমীরের শতভাগ আনুগত্যের কারণে কুরআনে একে ফাতহে মুবিন তথা স্পষ্ট বিজয় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
মাওলানা সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ
লেখক, গবেষক ও বহুগ্রন্থপ্রণেতা
মুহতামিম : জামিয়া কাশিফুল উলুম ঢাকা